If you want to surrender yourself to nature with just a few clothes on your back, you have to come to 'Chisang'. There are no shopping malls, markets.

মানুষের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলবার আগেই বেরিয়ে পড়া। কোথায় যাব? যেখানে মানুষের ভিড় নেই, আছে প্রকৃতির হাত উপুড় করে ঢেলে দেওয়া সৌন্দর্য -- সেখানে। যারা মানুষের,গাড়ির আওয়াজ থেকে দু একদিন নিরিবিলিতে পাখির ডাক শুনে কাটাতে চান, তাদের জন্য আদর্শ জায়গা চিসাং।
রাত ১০.১৫ শিয়ালদহ স্টেশন থেকে দার্জিলিং মেল ধরে পরদিন সকালে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামতেই প্রচন্ড বৃষ্টি। ভিজে একসা। চিসাং হোম স্টে থেকে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। ভিজে ভিজে গাড়ি তে উঠে রওনা দিলাম।
সেবক, করনেশন ব্রীজ, মন ভোলানো তিস্তা, চালসা, খুনিয়া মোড় হয়ে ঝালং যাবার রাস্তা ধরে এসে পৌঁছালাম চিসাং। প্রায় সাড়ে চার ঘন্টার পথ। এখানে থাকবো ওয়াইল্ড উড রিসর্টে, এদের আতিথেয়তার কোন ত্রুটি নেই। আগে থেকে থাকার জায়গা ঠিক না করে চিসাং আসা বোকামি। ভূটানের সীমানা ঘেঁষা কালিম্পং জেলার ছোট্ট গ্রাম। নেই কোন বাহারি দোকান, বাজার। আছে প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্য। গ্রামে হাতে গোনা কয়েকটি বাড়ি। বাড়ির সামনে রঙ- বেরং এর ফুলগাছ। পাহাড়ের ঢালে ছোট ছোট বড় এলাচের গাছ, সবুজের সমারোহ আর আছে ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি পাখিদের কলতান।
রিসর্টের ঘরের চাইতে ঝুলন্ত বারান্দাটি চমৎকার। এই হাতায় বসে এক পেয়ালা চায়ে চুমুক দিতে দিতে দূরে আবছায়া ভুটান পাহাড় - অপূর্ব। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামে,পাহাড় দীপাবলীর আলোয় সেজে উঠেছে। হোমস্টের গৃহকত্রী জানালেন ওটা তেন্দু উপত্যাকা --ভুটান।
পরদিন সকালে মেঘ-কুয়াশার মন খারাপ করা চাদর সরিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়লো বিছানার উপর। চাদর মুড়ি দিয়ে হাতায় এসে দাঁড়ালাম। নেই মানুষের কোলাহল। নিঝুম ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতার সঙ্গে কত রকমের পাখির ডাক। বিশ্বাস করুন এই পাখিগুলোর একটার ও নাম আমি জানি না কিন্তু কি মন ভোলানো সুর। প্রকৃতি আমার মনে একরাশ খুশির ডালি নিয়ে হাজির। ঘরের খোলা জানালা দিয়ে একখন্ড মেঘ এসে বলে গেল "তোমার মনের বয়স ছাব্বিশ। ঘরে বসে থেকো না। বেড়িয়ে পড়, ঘুরে এসো চারপাশ।"
আজ যাবো তোদে হাট, দাওয়াই খোলা, সীমানা খোলা, টাংতা মনেস্ট্রি। পুরানো দিনের ফোর হুইল ড্রাইভ উইলিস জীপ নিয়ে হাজির আমাদের চালক। তোদে হাট সপ্তাহে দু'দিন - শনি ও রবিবার বসে। বেশ লোক হয়েছে, সবাই স্থানীয়। আলু,পেঁয়াজ, সবজি - এমন কি জামাকাপড় কেনাবেচা চলছে। গাড়ি বোঝাই করে বাজার করছে। এঁরা নিস্তব্ধতা কে সন্মান করতে জানেন। কথা বলছে, গল্প করছে, দরদাম করছে - সবাই খুব নীচু গলায়। আমাদের গড়িয়াহাট, ধর্মতলা বা হাতিবাগানের মতন চিৎকার, গলাবাজি, চেঁচামিচি নেই। চিসাঙের খবর সমতলের বহু মানুষের কাছে অজানা তাই শহুরে (অ)সভ্যতার ঢেউ এখনও এখানে আছড়ে পড়ে নি।
এলাম দাওয়াইখোলা। 'খোলা' শব্দের অর্থ নদী । স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন এই নদীতে স্নান করলে নাকি অনেক অসুখ সেরে যায়, তাই নাম দাওয়াই খোলা।জলের গুণ দোষ বিচার করার দায় আমার নয়। আমি রুপের,সৌন্দর্যের বিচার করি। এই নদী দেখে আমি মুগ্ধ।
এলাম টাংতা মনেস্ট্রি। খুব ছোট, লোকের আনাগোনা নেই। আমাদের সারথি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। সে বললে এখানে লোকে দিক্ষিত হয়ে উপরের জঙ্গলে গিয়ে চার পাঁচ বছর ধ্যান করে। ভগবান তথাগতের স্নিগ্ধ মুর্তি।
এবারের গন্তব্য সীমানা খোলা। খাদের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা এক শীর্ণ ঝর্ণা। বর্ষায় এর রূপ হয়তো ভয়ঙ্কর। হড়পা বানে হয়তো সব লন্ডভন্ড করে দেয়। ছোট, মাঝারি, বড় পাথরের ফাঁক দিয়ে বয়ে চলেছে, অনেকটা মুর্তি নদীর মতন। চওড়া বিশ বাইশ ফুট হবে। নদীর ওপারে জঙ্গল - ভূটান। ইচ্ছে করলেই জল টপকে ওপারে যাওয়া যায়। দুই দেশের সীমানা রক্ষা করে চলেছে তাই সীমানা খোলা। দাওয়াই খোলা, সীমানা খোলা - এরা সব গিয়ে মিশেছে জলঢাকার সঙ্গে। এই রকম নদীকেই বোধহয় উপনদী বলে।
বিকেলের আগেই ফিরে এলাম আস্তানায়। চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে উদাস হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ভূটান পাহাড়ের দিকে। মাছের আঁশের মতন একটার পিঠে একটা পাহাড়। পাখিদের বাসায় ফেরার সময়, বাতাসে ভর করে ভেসে বেড়াচ্ছে তাদের কলতান। অন্ধকারের আস্তরণ নেমে আসছে, ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা লাগছে মুখে, চোখে। অন্ধকার আরও গাঢ় হ'ল; ভূটান পাহাড়ের বুকে ছোট গ্রামে আলোর মেলা, আকাশে হাজার তারা মিটিমিটি করে জ্বলছে। নিজের অজান্তে দুচোখ জলে ভরে গেল -- আনন্দাশ্রু না বেদনাশ্রু? জানি নে।
কাল চিসাং ছেড়ে চলে যাবো - 'পানাবু'। মনের মধ্যে বহুল প্রচলিত বাংলা সিনেমার একটি গানের কয়েকটি লাইন বুদবুদের মতন ভেসে উঠছে --
"যাবার বেলায় কিছুই না পাই, প্রাণ ভরে শুধু ছুঁই
স্বপ্ন দিয়ে সাজাই তোকে, কান্না দিয়ে ধুই
হাজার তারার আলোয় ভরা, চোখের তারা তুই
স্বপ্ন দিয়ে সাজাই তোকে, কান্না দিয়ে ধুই।"
রাতে বিছানায় শুয়ে মনে হচ্ছিল আর একটা দিন তেন্দু উপত্যকার কোলে থেকে গেলে ভালো হ'ত। আমার বাড়ির বারান্দার সামনে ইঁট, কাঠ, পাথরের জঙ্গল, এদের বাড়ির বারান্দার সামনে দেওদার, পাইন, এলাচের বনানী।
COMMENTS