আমার কল্লোলীনি কলকাতা | পর্ব - ১ | তুমিও হেঁটে দেখো কলকাতা ...

  BONG 24 : কলকাতা  হল  পশ্চিমবঙ্গের  রাজধানী। পূর্ব ভারতের বৃহত্তম শহর কলকাতা  ভারতের  বৃহত্তম মহানগরীয় অঞ্চলগুলিরও অন্যতম। একজন অনভিজ্ঞ...

 




BONG 24 : কলকাতা হল পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী। পূর্ব ভারতের বৃহত্তম শহর কলকাতা ভারতের বৃহত্তম মহানগরীয় অঞ্চলগুলিরও অন্যতম। একজন অনভিজ্ঞ পর্যটক প্রথম দর্শনেই কলকাতাকে দেখে যুগপৎ বিরক্ত ও মুগ্ধ হবেন। ফলে এই শহরকে উপেক্ষা করা তাঁর পক্ষে আর সহজ হবে না। বাংলার নবজাগরণের আঁতুরঘর কলকাতা সুদীর্ঘকাল ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত। সিটি অফ জয় উপন্যাসে দারিদ্র্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কলকাতার সাধারণ মানুষের সংগ্রামের ছবি এঁকেছিলেন ডোমিনিক ল্যাপিয়ের। সেই উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছিল। আর সেই উপন্যাসের নামটিই কলকাতাকে উপহার দিয়েছিল আর একটি নতুন নাম – ‘সিটি অফ জয়’ বা ‘আনন্দনগরী। ভারতের বহু কবি, সাহিত্যিক, নাট্যব্যক্তিত্ব, সংগীতজ্ঞ, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র পরিচালক এবং নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এই শহরে জন্মগ্রহণ করেন অথবা এখানেই নিজেদের কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। তাই কেউ কেউ মনে করেন ভারতের যে শহরগুলি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি প্রগতিশীল, সেগুলির অন্যতম এই কলকাতা। আপনি যদি ভারতের একটি কি দু’টি বড়ো শহরে বেড়াতে যাওয়ার কথা চিন্তা করে থাকেন, তবে কলকাতাকে আপনার গন্তব্যতালিকায় অবশ্যই স্থান দিতে পারেন। পছন্দ বা অপছন্দ যাই করুন না কেন, নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ‘আনন্দনগরী’কে আপনি ভুলতে পারবেন না।

কলকাতার ইতিহাসটি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত, যারা প্রথমত ১৬৬০ সালে আসে এবং ১৭৭২ সালে কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হয়ে ওঠে। জব চারনক কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন (স্থানটি সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কালীকাটা নামে ৩ টি গ্রাম হিসাবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে কলকাতা শহর হয়ে ওঠে।) কিন্তু কিছু ভারতীয় ঐতিহাসিক এই দাবিতে বিতর্ক করেন এবংন বলেন কলকাতার প্রাচীন কালি মন্দির এবং খিদিরপুরের বন্দরকে কেন্দ্র করে কলকাতা প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছিল।
যাই হোক না কেন কলকাতার উৎপত্তি, কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীতে পরিণত হয় ১৯তম শতাব্দীর সময়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রথম আধুনিক ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়১৮৫৭ সালে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কলকাতা ভারতীয় শিল্প ও সাহিত্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠে এবং স্বাধীনতার জন্য জাতীয় আন্দোলন শুরু হয় এখান থেকে। তবে, ১৯১১ সালে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পর ১৯৪৭ সালে বাংলার বিভাজনের যন্ত্রণা, স্বাধীনতার পর প্রায় দুই দশক ধরে চলমান সহিংস দমন ও সামন্তবাদী রাষ্ট্র পরিচালনা, যা ১৯৭০- এর দশকে মতাদর্শগতভাবে অনুপ্রাণিত মাওবাদী আন্দোলন (নকশাল আন্দোলন) অনুসরণ করে, মার্কসবাদী শাসন দ্বারা শহরটিকে তার বর্তমান রূপে রূপান্তরিত করে।
কলকাতা পূর্ব ভারতের প্রধান ব্যবসা, বাণিজ্যিক ও আর্থিক কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকের ভারতের অর্থনৈতিক উদারনীতির ফল ১৯০০-এর দশকের শেষ দিকে কলকাতা পৌঁছেছিল। কলকাতা একটি বহুবর্ষজীবী এবং মহাজাগতিক শহর, সমগ্র ভারত এবং ইউরোপীয়দের (জার্মানী, আর্মেনিয়ান, এবং অন্যান্যদের সহ) এবং অন্যান্য এশীয়দের (চীনের, সিংহলী এবং তিব্বতীসহ) বৈচিত্র্য সহ। কলকাতায় ভারতের সবচেয়ে বড় চিনাটাউন থাকার জন্যও উল্লেখযোগ্য, যা অনেক জাতিগত চীনা বাসিন্দাদের আবাসস্থল হিসাবে পরিচিত, যাদের পরিবার বহু প্রজন্ম ধরে কলকাতায় বসবাস করেছে।
১৯৭৭ সালে কমিউনিস্ট ও মার্কসবাদী দলগুলোর "বামফ্রন্ট" জোট ক্ষমতায় আসে এবং ৩৪ বছর ধরে রাজ্যকে শাসন করে। এটি লেনিন সরণি এবং হো চি মিন সরানি নামের সাথে রাস্তার নাম এবং স্মৃতিস্তম্ভগুলিতে প্রতিফলিত হয়। এই সময়ের মধ্যে, নিপীড়িত জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য বাস্তবায়িত বিভিন্ন সমতার দৃষ্টিভঙ্গিগুলি নগরকে সম্পদের অভাব কমাতে এবং দরিদ্রতা হ্রাসে সহায়তা করেছে।

কয়েকটি পর্বে আরও বিশদভাবে জেনে নেব আমাদের কল্লোলীনি কলকাতাকে।


কলকাতার ট্রামঃ 

ট্রাম হলো কলকাতা (Kolkata) শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন ব্যবস্থা। এটি এশিয়ার প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম পরিবহন ব্যবস্থা। ট্রাম পরিষেবা প্রথম চালু হয় ১৮৭৩ সালে। ট্রাম লাইনের কাজ শুরু হয় ২৪.০২.১৮৭৩ তারিখে। প্রথমে ঘোড়ার সাহায্যে ট্রাম চালানো হতো কিন্তু পরবর্তীকালে ১৯০২ সালে বিদ্যুতের ব্যবহার হয়।১৮৭৩ সালে আর্মেনিয়া ঘাট থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম ট্রাম চালু হয়। এই যাত্রা পথের দৈর্ঘ্য ছিল ৩.৯ কিলোমিটার।কিন্তু যাত্রীর অভাবে এই পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি নামে একটি লন্ডন ভিত্তিক কোম্পানি কলকাতায় ট্রাম পরিষেবা শুরু করে।


১৮৭৩ সালে ট্রাম কোম্পানিটির হাতে ১৭৭টি ট্রাম ও ১০০০ টি ঘোড়া ছিল। এই সময় ট্রাম কোম্পানির ১৯ মাইল ট্রাম লাইন ছিল।১৯০২ সালে ট্রাম পরিষেবার বৈদ্যুতীকরন শুরু হয়, যেটি ছিল এশিয়ার প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম পরিষেবা। স্বাধীনতার কিছু পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কলকাতা ট্রাম কোম্পানিকে অধিগ্রহণ করে। বর্তমানে এটি ভারতের একমাত্র ট্রাম পরিসেবা।


কলকাতা ট্রাম-এর ৭টি ট্রাম ডিপো রয়েছে, এগুলো হলো: বেলগাছিয়া, রাজাবাজার, পার্ক স্ট্রীট, গড়িয়াহাট, টালিগঞ্জ, কালিঘাট ও খিদিরপুর। আর, টার্মিনাল রয়েছে ৯টি, এগুলো হলো; শ্যামবাজার, গালিফ স্ট্রীট, বিধাননগর, বালিগঞ্জ, এসপ্লানেড, বিবাদি বাগ ও হাওড়া ব্রীজ।


ট্রাম পরিষেবা বর্তমান কলকাতার পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে।একমাত্র দেশের মধ্যে কলকাতার বুকে গড়গড়িয়ে চলে এই ট্রাম। শুটিং স্পট হিসাবে বাংলা,হিন্দি, ইংরেজি সিনেমাতেও ব্যবহার দেখা যায় অহরহই। ফটোগ্রাফারদের ভীষণই পছন্দের আইকন এই ট্রাম।কলকাতার ঐতিহ্য,কলকাতার প্রতীক হিসাবে নিজের জায়গা করেছে ট্রাম অনায়াসেই।কলকাতা ট্রাম পরিষেবা দেশীয় ও বিদেশীয় পর্যটকদের জন্য দূর্গাপুজোর দিনগুলিতে চালু করেছে বিশেষ প্যাকেজ। 


এছাড়াও এসি ট্রাম তো আছেই সুন্দর আরামদায়ক চেয়ারের সুবিধা নিয়ে। আর যে জায়গা দিয়ে বিচরণ এই ট্রামের তা হলো কলকাতার স্বর্গ,প্রাণকেন্দ্র, ছবি তোলার আদর্শ জায়গা।বর্তমানে যদিও ট্রামকে আমরা আরো কিছু বেশি পরিসরে পেয়ে থাকি। ট্ৰাম লাইব্রেরী , ট্রাম মিউজিয়াম (স্মরণিকা), ট্রাম রেঁস্তোরা (ভিক্টোরিয়া), হেরিটেজ টুর ট্রাম(চড়ুইভাতি)। ট্রামেই পাওয়া যাবে পাটের তৈরি জিনিসপত্র। সাথে থাকবে কলকাতার ঐতিহ্যের ধারা ভাষ্য। যা বিভিন্ন আঙ্গিকে ট্রামকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। এভাবেই যেনো চলতে থাকে ট্রাম ইতিহাস ও বর্তমানের সাক্ষী হয়ে সব প্রজন্মের মানুষের হাত ধরে, আমাদের কলকাতার গৌরবকে বজায় রাখতে।

শামবাজারের পাঁচ মাথার নেতাজীর মুর্তিঃ

মূর্তি নিয়ে সেদিনও কম হইচই, বিতর্ক হয়নি কলকাতায়। সেদিন বলতে অর্ধশতাব্দী আগে। মূর্তিটা অবশ্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছিল না। আর হইচই, বিতর্কটাও কিন্তু মূর্তি ভাঙার পর হয়নি, হয়েছিল মূর্তি স্থাপনের পর। কথা হচ্ছে, শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের বিখ্যাত অশ্বারূঢ় মূর্তিটি নিয়ে। দেখতে দেখতে পঞ্চাশটি বছর বয়স হয়ে গেল এই মূর্তির। 
বিতর্ক কেন? নেতাজির মূর্তি বসানো নিয়ে আপত্তি ছিল নাকি কারো? নাহ, এমন অবান্তর ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়াই অনুচিত। বিতর্কের কারণ ছিল মূর্তিটি অপছন্দ হওয়া। নেতাজি-মূর্তির আকৃতি ও কাঠামো নিয়ে বেশ অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল অনেকের মনে। আর মূর্তির আকৃতি এমনতর হওয়ার মূলে ছিল অন্য একটি মূর্তি। নেতাজির মূর্তি নয়, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল স্যার জেমস উট্রামের ঘোড়ায় চড়া মূর্তি। সেই মূর্তির অনুকরণেই  গড়া হয়েছিল শ্যামবাজার মোড়ের বহু-আলোচ্য এই মূর্তিটি। তৎকালীন সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী অবশ্য ‘অক্ষম অনুকরণ’।
কলকাতায় নেতাজির প্রথম পূর্ণাবয়ব মূর্তিটি বসেছিল রাজভবনের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। ১৯৬৫ সালে। আর, কলকাতা পৌরসংস্থার পক্ষ থেকে পনেরো ফুট এক ইঞ্চি উচ্চতাবিশিষ্ট নেতাজির এই ব্রোঞ্জের মূর্তিটি স্থাপিত হল তার চার বছর পরে। কলকাতায় নেতাজির দ্বিতীয় পূর্ণাবয়ব মূর্তি এটিই। এবং হয়তো সবচাইতে আলোচিত এবং বিখ্যাত মূর্তিও। শ্যামবাজার মোড় আর এই মূর্তি অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠবে এরপর থেকে। ঘোড়ার ওপর সওয়ার নেতাজি। ডানদিকে ঘুরে তাঁর মুখ-সহ শরীরের অর্ধেক। হাতে ঘোড়ার রাশ। ঘোড়াও যেন গতিতে আছে। দেখলেই চোখ টানে। কিন্তু নানা কারণেই মূর্তির গড়ন তৎকালীন কলকাতাবাসীকে খুশি করতে পারেনি। কিন্তু, অসন্তোষের পাশাপাশি এই মূর্তিকে ঘিরে মানুষের উত্তেজনাও ছিল চোখে পড়ার মতো।
শ্যামবাজারে নেতাজি-মূর্তি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ১৯৫৮ সালে। তখন কলকাতা পৌরসংস্থার মেয়র ত্রিগুণা সেন। অথচ মূর্তি তৈরি হতে লেগে গেল আরো এগারোটি বছর। মূর্তি গড়ার দায়িত্ব দেওয়া হল মারাঠি ভাস্কর নাগেশ যবলকরকে। এরপর, নেতাজির ৭৩তম জন্মদিনে উদ্বোধন হল মূর্তির। সশরীরে উপস্থিত থাকতে না পারলেও লিখিত ভাষণ পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাকির হুসেন এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী। মূর্তি উদ্বোধনে নাকি লক্ষেরও বেশি মানুষের ভিড় হয়েছিল। 

মূর্তি বসানোর আগে সমস্যা তৈরি হয়েছিল মাটির নিচে জলের পাইপলাইন নিয়ে। তার ওপরে মূর্তির চাপ পড়লে তো সর্বনাশ। এদিকে মোড়ের মাঝখান ছাড়া মূর্তি বসানোর জায়গাও নেই। রাস্তা খুঁড়ে পাইপলাইন সরানোও বিপুল হ্যাপা। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক হল, পাইপলাইনের দু’পাশে দুটো কংক্রিটের কাঠামো তৈরি করে তার ওপরে বিম দেওয়া হবে। এবং সেই বিমের ওপরেই বসানো হবে নেতাজি মূর্তি। এভাবেই ১৬ ফুট উঁচু বেদীর ওপর ঘোড়সওয়ার নেতাজির মূর্তি বসল। মুম্বইতেই তৈরি হল মূর্তি। তারপর তিনভাগে নিয়ে আসা হল কলকাতায়। নাগেশ যাবলকর নিজে এসে তত্ত্বাবধান করলেন মূর্তি স্থাপনের। সবমিলিয়ে খরচ পড়েছিল তৎকালীন দিনেও লক্ষাধিক টাকা। মূর্তি-স্থাপনের আগে এবং পরে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়
এবং সেই মূর্তি দেখে অনেকেরই পছন্দ হল না। মূর্তি প্রতিষ্ঠার পরেরদিনই ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় একটি লেখার শিরোনাম হল ‘বীরকে নিয়ে ব্যঙ্গ’। সেখানে বলা হল, ‘এ কেমন নেতাজী মূর্তি পৌরসভার? এ ওদের বীরের প্রতি ব্যঙ্গ।’ এই মূর্তিতে নাকি শৌর্যবীর্যময় নেতাজির আসল মূর্তিকে অপমান করা হয়েছে। এই শোরগোল, প্রতিবাদের মধ্যেই কলকাতাবাসী জানতে পারলেন, এই মূর্তি ময়দানের জেমস উট্রামের মূর্তির আদলে গড়া। নেতাজি মূর্তি গড়ার জন্য ১৬ জন কাউন্সিলরের একটি বিশেষ কমিটি তৈরি হয়েছিল। তাঁরা নাকি নানা অ্যাংগেল থেকে ঘোড়াসমেত উট্রামের মূর্তির ছবি তুলে মুম্বইতে গিয়ে দিয়ে এসেছিলেন ভাস্কর নাগেশ যবলকরকে। সেই ছবি দেখেই মূর্তি গড়লেন নাগেশ। জন হেনরি ফলির গড়া সেই মূর্তিতেও উট্রাম ডানদিকে ঘুরে বসেছেন ঘোড়ার পিঠে চেপে। ডানহাতটি ঘোড়ার পিঠে রেখে ভারসাম্য রেখেছেন। সেই হাতে একটি ধারালো তরবারিও রয়েছে। মুখটা অবশ্য সামান্য পিছনে ঘোরানো, যেন চলন্ত ঘোড়া থেকেই পিছনে তাকাচ্ছেন সশস্ত্র উট্রাম। আদ্যন্ত কালো মূর্তিটি থেকে ব্রিটিশসুলভ আভিজাত্য যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে।উট্রামের সেই মূর্তি এবং নেতাজির মূর্তি
এই মূর্তি দেখে লোভ হওয়াই স্বাভাবিক। প্রায় একই আকারের ঘোড়ার পিঠে উট্রামের বদলে নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে কল্পনা করেছিলেন মূর্তির পরিকল্পনাকারীরা। নাগেশ যবলকর চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু দুটি মূর্তির তুলনা করলে বলতেই হয়, সেই চেষ্টায় তিনি পুরোটা সফল হননি। ঘোড়া কিংবা নেতাজি সুভাষ—কোনোটারই গড়ন উট্রামের মূর্তিকে টেক্কা দেওয়ার মতো হয়নি। যেহেতু উট্রামের মূর্তি আগেই দেখে ফেলেছিলেন শহরবাসী, ফলে এই পার্থক্যটা চোখে ধরাও পড়ল বড়ো বেশি করে।  
এই অপছন্দ-প্রতিবাদ সত্ত্বেও নেতাজির এই মূর্তি ক্রমে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের প্রধান চরিত্র হয়ে উঠল। বিধান সরণী, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড, বিটি রোডের দিকে বয়ে যাওয়া বিধান সরণীর রেশ, আরজি কর রোড কিংবা ভূপেন বসু এভিনিউ—যেদিক দিয়েই আসা যাক, এই মূর্তিতে চোখ আটকাবেই। স্কুলবয়সে দেদার চর্চার বিষয় হয়ে উঠবে নেতাজির মুখ কোনদিকে কেন ঘোরানো, তাই নিয়ে। এবং, বিভ্রমের মতো বারবার অনেকে কল্পনা করবে এই মূর্তিতেও নেতাজি আঙুল তুলে দিক নির্দেশ করছেন। যেমনটা আমরা দেখেছি নেতাজির অনেক প্রচলিত আঁকা ছবিতে। যেন আঙুল উঁচিয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন ‘দিল্লি চলো’। কিন্তু, আদতে তো সুভাষচন্দ্রের ডানহাত ঘোড়ার পিঠেই রাখা এই মূর্তিতে। তাহলে কি আমরাই বারবার চাই নেতাজি দিকনির্দেশ করুন? তৎকালীন শহরবাসীও কি সেটাই চেয়েছিলেন এই মূর্তি থেকে?
সেই চাওয়া-পাওয়া-না পাওয়া-অভিমান আর মুগ্ধতার জাল কাটিয়ে কাটিয়েই সময় ছুট লাগায়। কিন্তু শ্যামবাজারের মোড়ে নেতাজির মূর্তি ছুটেও ছোটে না। পঞ্চাশটি বছর! কম নয়। চলন্ত ঘোড়ায় স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে নেতাজি। শহরের অন্যতম আইকন। যত খুঁতই থাক, এই মূর্তিরও যে নিজস্ব একটা আভিজাত্য আছে তা অস্বীকার করা যাবে না কিছুতেই।

স্টার থিয়েটার

স্টার থিয়েটার হল কলকাতার একটি নাট্যমঞ্চ। এটি ১৮৮৩ সালে স্থাপিত হয়েছিল। স্টার থিয়েটার প্রথমে বিডন স্ট্রিটে অবস্থিত ছিল পরে এটি কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে (অধুনা বিধান সরণি) স্থানান্তরিত হয়। স্টার থিয়েটার ভবনটি উত্তর কলকাতার হাতিবাগান অঞ্চলে অরবিন্দ সরণি ও বিধান সরণির সংযোগস্থলের কাছে অবস্থিত। শোভাবাজার সুতানুটি মেট্রো স্টেশন এই থিয়েটারের নিকটবর্তী মেট্রো স্টেশন। স্টার ও মিনার্ভা থিয়েটার হল কলকাতার দুটি সবচেয়ে পুরনো বাণিজ্যিক নাট্যমঞ্চ। স্টার, মিনার্ভা ও ক্লাসিক থিয়েটারে হীরালাল সেন নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। 



স্টার থিয়েটার ভবনটি কলকাতার একটি ঐতিহ্যবাহী ভবন। ১৯৯০-এর দশকে একটি অগ্নিকাণ্ডে এই ভবনটি ভষ্মীভূত হয়েছিল। ২০০০-এর দশকে কলকাতা পৌরসংস্থা বাড়িটি সারিয়ে আবার নাট্যমঞ্চটি চালু করে। বর্তমানে স্টার থিয়েটারের সম্মুখভাগটি পুরনো স্থাপত্যশৈলী অনুসারে নির্মিত হলেও, ভিতরের অংশটি আধুনিক। এখানে নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার পাশাপাশি চলচ্চিত্রও প্রদর্শিত হয়। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে এই হলে নাটক বেশি সংখ্যায় মঞ্চস্থ করা হয়। স্টার থিয়েটারের নিচে একটি ভূগর্ভস্থ গাড়ি পার্ক করার জায়গা বানানো হয়েছে।

এই নাট্যমঞ্চটি স্থাপনে বিশিষ্ট নাট্য অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীর নাম বিশেষভাবে স্বীকৃত হয়। নাট্যকার ও অভিনেতা গিরিশচন্দ্র ঘোষ ১৮৮০-এর দশকে এই মঞ্চে অনেকগুলি নাটক প্রযোজনা ও মঞ্চস্থ করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ পরমহংস ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই মঞ্চে নাট্যাভিনয় দেখতে এসেছিলেন। ২০১২ সালে এই ঐতিহাসিক ভবনটিকে তাই সরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়।

ঠনঠনিয়া কালীবাড়িঃ

ঠনঠনিয়ার শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির বা ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি কলকাতার ঠনঠনিয়া অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রাচীন কালী মন্দির। এটি কলেজ স্ট্রীট মোড় থেকে একটু দূরে বিধান সরণিতে অবস্থিত।


জনশ্রুতি অনুসারে ১৭০৩ খ্রিষ্টাব্দে উদয়নারায়ণ ব্রহ্মচারী নামে জনৈক তান্ত্রিক মাটি দিয়ে সিদ্ধেশ্বরী কালীমূর্তি গড়েন। ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দে শঙ্কর ঘোষ নামে জনৈক ধনাঢ্য ব্যক্তি বর্তমান কালীমন্দির ও পুষ্পেশ্বর শিবের আটচালা মন্দির নির্মাণ করেন ও নিত্যপূজার ব্যয়ভার গ্রহণ করেন। এখানে মায়ের মূর্তি মাটির, প্রতি বছর মূর্তি সংস্কার করা হয়। ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণীর পুজো, কার্তিক অমবস্যায় আদিকালীর পুজো ও মাঘ মাসে রটন্তী কালীর পুজো হয়।

চলবে ...

ভিডিও নির্মানঃ দেবাশীষ মুখার্জী, সঞ্জয় কুমার দত্ত ও কৌস্তুভ দাসগুপ্ত  Clickart Media


COMMENTS

নাম

অজানা তথ্য,5,আন্তর্জাতিক,6,ছোটগল্প,2,ডিয়ার বেঙ্গল,23,বিনোদন,19,ব্লগSHOT,24,ভাগ্যলিপি,1,ভারতকথা,3,ভ্রমন কাহিনী,7,লাইফস্টাইল,16,সাম্প্রতিক,100,স্বাস্থ্য কথা,13,হ্যাংলা পেটুক,6,
ltr
item
Bong24.in: আমার কল্লোলীনি কলকাতা | পর্ব - ১ | তুমিও হেঁটে দেখো কলকাতা ...
আমার কল্লোলীনি কলকাতা | পর্ব - ১ | তুমিও হেঁটে দেখো কলকাতা ...
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEi2qvE3MIWb86qhv8rwCt9BcvVFp0ogl4gtlYRLtM8sMyuUVC-lm1Ntd__VFOyKip2AM5Q5F7fWfnA7dEV0SHnCsSEt9G25yKJU5DqSPbfZGGHcxgkIRRGObbcVXdwL8tFVFo3fKShrP9ivsk3JHX3-4PSej9mDPgASzgg5Kb0VkIubntjn64urAQ/s16000/AMARKAKO%20P_1.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEi2qvE3MIWb86qhv8rwCt9BcvVFp0ogl4gtlYRLtM8sMyuUVC-lm1Ntd__VFOyKip2AM5Q5F7fWfnA7dEV0SHnCsSEt9G25yKJU5DqSPbfZGGHcxgkIRRGObbcVXdwL8tFVFo3fKShrP9ivsk3JHX3-4PSej9mDPgASzgg5Kb0VkIubntjn64urAQ/s72-c/AMARKAKO%20P_1.jpg
Bong24.in
https://www.bong24.in/2022/08/kolkata.html
https://www.bong24.in/
https://www.bong24.in/
https://www.bong24.in/2022/08/kolkata.html
true
3543138551337409656
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Content