রাজকুমার মুখার্জী, শিলংঃ পাইন, ঝাউ, দেওদার, রডোডেনড্রন গাছের পাশ দিয়ে মাখন মসৃণ কালো পিচ ঢালা রাস্তা, গথিক স্টাইলের বাংলো প্যাটার্নের বাড...
রাজকুমার মুখার্জী, শিলংঃ পাইন, ঝাউ, দেওদার, রডোডেনড্রন গাছের পাশ দিয়ে মাখন মসৃণ কালো পিচ ঢালা রাস্তা, গথিক স্টাইলের বাংলো প্যাটার্নের বাড়ী, কখনও মেঘ কখনও রোদ - কি! ভাবতে বললে কোন শহরের কথা মনে পড়ে? না না, বিদেশের কোন শহর নয়; আমি বলছি মেঘ মুলুকের রাজধানী শিলং শহরের কথা। গুগল ঘেঁটে এতক্ষনে বের করে ফেলেছেন তো কি করে যেতে হয়, কোথায় থাকবেন, কে বসিয়েছিল এই শহর, ব্রিটিশরা কবে এসেছিল - ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি ওই পথে যাচ্ছি না। আমি বলবো শিলং শহরের প্রাণ ভোমরার কথা।
নভেম্বরের শুরুতে গেছলাম শিলং। কেন শিলং ? আমার পাশের বাড়িতে যাঁরা থাকেন, তাঁরা বহুদিন কর্মসূত্রে শিলং এর বাসিন্দা ছিলেন। তাঁদের কাছে শিলং শহরের গল্প অনেক শুনেছি। এই গল্প শুনতে শুনতে কবে যে দেখার ইচ্ছে প্রবল হয়ে গেল -- বুঝতে পারি নি।
আদ্যপান্ত সাহেবি কায়দার শহর শিলং। বাংলো টাইপের বাড়ি, ঝকঝকে রাস্তা। পুলিশ বাজারের centre Point অঞ্চল টুকু বাদ দিলে শহরটা বেশ ছিমছাম। শিলং ঘুরে দেখতে গেলে একটা দিনই যথেষ্ট। সঙ্গে দুটো দিন হাতে রাখুন। বেড়িয়ে নিন ডাউকি এবং চেরাপুঞ্জি।
শিলং পাহাড়ের গল্প করতে গেলে সবার আগে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা চির বসন্তের উপন্যাস "শেষের কবিতা" র কথা। এই পাহাড়ী পথেই মোটরের ধাক্কায় প্রথম আলাপ হল লাবন্য এবং অমিতের। শিলং শহরে আসবেন অথচ কবিগুরুর বাড়ী (Tagore House) দেখবেন না -- তাই কখনও হয়! বাড়ির পিছনে বিশাল ইউক্যালিপটাস গাছ আজও তার ধ্বজা উড়িয়ে সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে।
শহর থেকে সামান্য দূরে আর্মিদের তত্ত্বাবধানে -- শিলং পিক। চোখে দূরবীন লাগিয়ে শহরটাকে দেখুন। দেশলাই বাক্সের মত সব বাড়ি পাহাড়ের অলিন্দে দাঁড়িয়ে। আড়ে বহরে বেড়ে যাবার আগেই শহর নিজেকে বেঁধে রেখেছে।
বিশাল চত্বর জুড়ে শহরের সবচাইতে পুরানো চার্চ। চার্চের সামনে সমতল খোলা অঙ্গন, তার একপাশে মুক্ত মঞ্চ। পিছনে আর্চ বিশপের বাড়ী, চার্চের গায়েই Loreto Convent। রাস্তার অন্য পাশে ছেলেদের স্কুল St Stephen's। বড়দিনে এই চার্চ আলোর মালায় সজ্জিত হয়ে ওঠে।
গাড়িতে চড়ে ঘুরে নেওয়া যেতে পারে GPO, Golf Course, Polo Ground, High Court। Ward Lake এ পৌঁছে আপনাকে গাড়ি থেকে নামতেই হবে। টিকিট কেটে ঢুকতে হবে। আয়তনে খুব একটা বড় কিছু নয়। লেকের ধারে পাহাড়ের ঢালের মত করা। সবুজ গালিচার মত লন। সুন্দর করে ছাঁটা ঘাস। যত্ন করে বাগানে ফুলের চাষ করা। গাছের ফুল তুলতে যাবেন না। প্রহরী এসে ধরবে, খাসি ভাষায় আপনাকে কি বলবে, বুঝতে পারবেন না। তাছাড়া, ফুল, গাছে দেখতেই বেশী ভালো - ফুলদানী বা খোঁপায় নয় - এটা সবাই বুঝতে পারে না।হাতির পিঠের আকৃতির মতন একটা পাথরের উপর থেকে ঝর্না নামছে ফার্ন গাছের পাশ দিয়ে -- এলিফ্যান্টা ফলস। সঙ্গে আরও দুটি ফলস আছে। অনেকগুলি সিঁড়ি ভেঙে নেমে দেখতে হবে। এবার চলুন উমিয়ম লেক দেখতে। শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার আগে এই লেক। চারিদিকে পাহাড় ঘেরা নীল জলের লেক। মানুষের তৈরী। উপর থেকে লেকের সৌন্দর্য আলাদা। সূর্যাস্তের মায়াবী আলোর রেশ ধরে ফিরে চলুন হোটেলে। সন্ধ্যার জমজমাট পুলিশ বাজার, কলকাতার হাতিবাগান বা গড়িয়াহাট কে হার মানিয়ে দেবে। রাত আটটায় সব বন্ধ হয়ে যাবে, তার আগেই ঘুরে নিন।
পরদিন সকালে উঠে বেরিয়ে পড়ুন ডাউকি দেখতে। ভোরের শিলং বড় রোমান্টিক। দুটো দিন শিলং শহরে থাকলে, হলফ করে বলতে পারি, প্রেমে পড়ে যাবেন। মসৌরী, দার্জিলিং, মানালি -- শিলং সবার থেকে আলাদা। তাই বোধহয় কবিগুরুর "শেষের কবিতা" র প্রেক্ষাপট অন্য কোন শৈল শহর নয়, শুধুই শিলং।
"তবু সে স্বপ্ন নয়
সব চেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়,
সে আমার প্রেম।
তারে আমি রাখিয়া এলেম
অপরিবর্তনের অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশে,
পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে
কালের যাত্রায়।
হে বন্ধু, বিদায়।"








COMMENTS